কালীগঞ্জে স্বজনদের অবহেলায় প্রসূতীর মৃত্যু, ফেঁসে গেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

received_495815749214939-1.jpeg

মোঃ ইব্রাহীম খন্দকার,কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধিঃ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যাওয়ার পথে স্বজনদের অবহেলায় শিরিন বেগম (৩২) নামে এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফেঁসে গেছে। প্রসব বেদনা উঠার পর সংকটাপন্ন প্রসূতীকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরাঘুরি এবং একাধিক ডাক্তার রোগীকে ঢাকায় ও গাজীপুরে রেফার্ড করার পরও সেখানে না নিয়ে কালক্ষেপনের বিষয়টি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শনিবার (২০ আগষ্ট) সন্ধ্যা ৭টায় উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের চুয়ারিয়াখোলা গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের গর্ভবতী স্ত্রী শিরিন বেগমের (৩২) সিজার করার জন্য তার স্বজনরা “সেন্ট মেরি’স ক্যাথলিক মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতাল” এ নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষার পর রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ দেখে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় রেফার্ড করেন। ঢাকায় না নিয়ে পরদিন ভোর ৫টায় প্রসব ব্যাথাসহ পুনরায় রোগীকে তার স্বামী ওই হাসপাতালেই নিয়ে গেলে ডাক্তার গর্ভের বাচ্চার বয়স পূর্ণ না হওয়ায় সিজার সম্ভব নয় বলে তাকে আবারো ঢাকায় রেফার্ড করেন। তারপরও সে প্রসূতীকে ঢাকায় না নিয়ে সকাল ৭টায় কালীগঞ্জ ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তার না থাকায় কর্তৃপক্ষ প্রসূতীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে সকাল সাড়ে ৭টায় তাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে নিয়ে যায়। সেখানেও কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীর সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে গাইনী বিশেষজ্ঞের সাথে ফোনে কথা বলে তাকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক একাধিক ডাক্তারের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে তার সংকটাপন্ন গর্ভবতী স্ত্রীকে কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। স্বজনদের দাবির প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অপারেশনের জন্য ডাক্তার মাসুদকে ইনকলে নিয়ে আসেন। ডাক্তার মাসুদ প্রসূতীর অপারেশন করেন এবং একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। অপারেশনের পর রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে একব্যাগ এবি+ রক্ত পুশ করে ডাক্তার রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার্ড করেন। হাসপাতাল থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে প্রসূতী শিরিন আক্তার মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয়দের ধারণা, সংকটাপন্ন অবস্থায় প্রসূতীকে নিয়ে তার স্বামী স্বজনদের একাধিক হাসপাতালে ঘুরাঘুরি, ডাক্তারদের পরামর্শকে অবজ্ঞা, অবহেলা ও সময়ক্ষেপণের কারণেই ঢাকায় নেওয়ার পথে প্রসূতীর মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে সেন্ট মেরি’স ক্যাথলিক মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাঃ তপতী কস্তা প্রতিবেদককে জানান, শনিবার সন্ধ্যায় পানি ভাংগা অবস্থায় প্রসূতী শিরিনকে তার স্বজনরা অপারেশনের জন্য আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন। গর্ভের বাচ্চার বয়স ৩৫ সপ্তাহ হওয়ায় এবং ইনকিউভেটর না থাকায় আমরা রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার্ড করি। কিন্তু রোববার ভোরে প্রসব ব্যাথা নিয়ে পুনরায় প্রসূতীকে তার স্বামী হাসপাতালে এনে অপারেশন করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। অপারেশনে ঝুঁকি থাকায় আমরা রোগীকে পুনরায় ঢাকায় রেফার্ড করি।
পরে এ বিষয়ে কালীগঞ্জ ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম জানান, রোববার সকাল ৭টায় সংকটাপন্ন অবস্থায় গর্ভবতী শিরিনকে নিয়ে তার স্বামী আমাদের হাসপাতালে আসেন। ওই সময় রোগীর সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে আমরা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেই।
পরে এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাঃ সাানজিদা পারভিন জানান, রোববার সকাল ৭.৩৫ মিনিটে প্রসূতী শিরিনকে তার স্বামী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসেন (সিরিয়াল নং ১৮৭৬)। আমি হাসপাতালে আসার পথে কর্তব্যরত ডাক্তার বিষয়টি আমাকে ফোনে জানান। আমি ডাক্তারের কাছে বিস্তারিত শুনে রোগীকে দ্রুত শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করার জন্য বললে ডাক্তার রোগীকে সেখানে রেফার্ড করেন।
শিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালটেন্ট অভিযুক্ত ডাঃ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ জানান, রোববার সকালে আমি কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ফোনে প্রসূতীর সংকটাপন্ন অবস্থার কথা শুনে মানবিক কারণে কালীগঞ্জে জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে যাই। সেখানে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অপারেশন করি। অপারেশনের পর রোগীর জরায়ু ফাটা দেখে আমি সেলাই করি এবং আভ্যন্তারিন ভাবে রক্তক্ষরণ হওয়ায় দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করতে বলি। পরে ক্রসম্যাচিংয়ে এবি+ রক্ত ব্যবস্থা করে দিলে আমি নিজে এক ব্যাগ রক্ত রোগীর শরীরে পুশ করি। প্রথম অপারেশনের পর দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ এবং প্রসব ব্যথার পর সময়ক্ষেপণ করার কারণে প্রসূতীর জরায়ু ফেটে আভ্যন্তরিণ রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেখানে আমি প্রায় দেড় ঘন্টা রোগীকে পর্যবেক্ষণ করি এবং তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার্ড করে চলে যাই। পরে জানতে পারি রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায়। আমি এনেস্থেসিয়া ও সার্জারির উপর উচ্চ প্রশিক্ষিত। আমার যাবতীয় কাগজপত্র তদন্ত কমিটির কাছে জমা দিয়েছি।
জনসেবা হাসপাতালের পরিচালক বন্যা আক্তার প্রতিবেদককে বলেন, প্রসূতীর স্বামী আব্দুর রাজ্জাক আমার প্রতিবেশী। রোববার সকালে তিনি হাসপাতালে গিয়ে আমার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তার গর্ভবতী স্ত্রীর অপারেশন করার জন্য কাকুতি মিনতি করেন। আমি ফোনে রোগীর বিষয়টি তার স্বামীর কাছে শুনে মানবিক কারণে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য বলি। পরে রোগীর স্বামীর অনুরোধে ইনকলে ডাঃ মাসুদকে অপারেশনের জন্য নিয়ে আসি। অপারেশনের পর আভ্যন্তরিণ ভাবে রক্তক্ষরণ হওয়ায় রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে স্বজনদের দ্রত ‘এবি+’ রক্তের ব্যবস্থা করে দিতে বলি। পরে ডোনারের মাধ্যমে রোগীর শরীরে ‘এবি+’ রক্ত পুশ করি। রোগীর শারীরিক অবস্থার বিষয়ে স্বজনরা তথ্য গোপন করেছিল। আমরা পরে সব কিছু জানতে পেরে রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার্ড করি। মূলত স্বজনদের গাফিলতি এবং সময়ক্ষেপণ করার কারণেই ঢাকায় নেওয়ার পথে প্রসূতীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালের যাবতীয় কাগজপত্র ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে নবায়নের জন্য জমা দেওয়া হয়েছে কিন্তু এখনো নবায়নকৃত কাগজপত্র হাতে পাইনি।
তবে প্রসব বেদনা উঠার পর সংকটাপন্ন প্রসূতীকে বিভিন্ন হাসপাতাল হতে ঢাকায় ও গাজীপুরে রেফার্ড করার পরও সেখানে না নিয়ে কালক্ষেপনের বিষয়ে জানার জন্য বাদীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে বারবার কল করার পরও তিনি কল রিসিভ না করায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার কোন জবাব পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস.এম মনজুর-এ-এলাহী বলেন, ‘জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ঘটনায় ডাঃ সানজিদা পারভীন (গাইনী বিভাগ) কে আহবায়ক ও ডাক্তার মুনমুন আক্তার (গাইনী বিভাগ) এবং মোঃ এমরান (এনেস্থেসিয়া) কে সদস্য করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আনিসুর রহমান জানান, প্রসূতী মৃত্যুর ঘটনায় গত মঙ্গলবার (২৩ আগষ্ট) রাতে র‌্যাব-১ অভিযান চালিয়ে হাসপাতালের পরিচালক বন্যা আক্তার (৩১), মোঃ আশিকুর রহমান (২৫), সঙ্গীতা তেরেজা কস্তা (৩৩), মেরী গমেজ (৪০), সীমা আক্তার (৩৪), শামীমা আক্তার (৩২) কে আটক করে র‌্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। বুধবার রাতে আটককৃতদের র‌্যাব-১ কালীগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করে। এ ঘটনায় ভিকটিমের স্বামী বাদী হয়ে আটকৃত ৬জন, মোঃ জহিরুল, ডাঃ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ও শাওন সহ মোট ৯জনের নামে এবং অজ্ঞাত ৬/৭ জনের নামে একটি মামলা দায়ের করেছেন, যার নং ১৮, তারিখঃ ২৪/০৮/২২। আটককৃত ৬জনকে বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুর আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। বাকি আসামীদের গ্রেফতারে অভিযান প্রক্রিয়াধীন।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top