দিন প্রতিদিন ডেস্ক:
বয়সের ভারে দুজনই ন্যুব্জ। এখন সুখ-দুঃখের সঙ্গী। একজন অন্যজনকে মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন।
কেউ পড়ে ছিলেন রাস্তায়, কেউ বা উদ্বাস্তু হয়ে মাজারে, আবার কেউ হাসপাতালের বারান্দায়, কেউ বা স্বজন দ্বারা বিতাড়িত। এক মাসের শিশু থেকে ১১০ বছর বয়সী প্রবীণ অসহায়—এমন ৮৫ জন মানুষের আশ্রয়স্থল এখন রাজধানীর উত্তরখানের মৈনারটেক এলাকায় নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য গড়ে তোলা ‘আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম’। অসহায় এই মানুষদের খোঁজ নিতে গতকাল শনিবার সরেজমিনে বৃদ্ধাশ্রমটি ঘুরে দেখা হয়।
বৃদ্ধাশ্রমসেখানে কথা হয় ৭০ বছরের প্রবীণ আমেনা খাতুনের সঙ্গে।
কথায় কথায় বললেন, ‘বিয়ের পর সুখে-দুঃখে ভালোই কাটছিল সংসার। কয়েক বছর পর একটা মাইয়া হইলো। দুই বছর বয়সে মইরা গেল। এরপর আর সন্তান হয় নাই।
পরে অন্যের মাইয়ারে দত্তক নিলাম। অনেক আদর-যত্নে লালন-পালন কইরা বিয়া দিলাম। ২৫ বছর ঘর-সংসার করার পর হঠাৎ স্ট্রোক কইরা আমার স্বামী মইরা গেল। এতে আমার জীবনে নাইমা আইলো আন্ধার।
দত্তক মাইয়াসহ কেউ আর আমার দায়িত্ব নিল না। দেবর-জা আমারে বাড়ি থেইকা খেদায় দিল। এরপর থেইকা এইহানে আশ্রয় নিছি।’
আমেনা খাতুন দুই বছর ধরে এখানে আশ্রয়ে আছেন। নারায়ণগঞ্জে জন্ম।
হাজীগঞ্জ উপজেলায় স্বামীর বাড়ি। কাঠের মিলে কাজ করতেন স্বামী। আমেনা আরো বলেন, ‘স্বামী থাকতেই চোখের সমস্যা ছিল। স্বামী মরছে পরে কানতে কানতে চোখের আলো চইলা গেল। স্বামী থাকতে দুইবার অপারেশন করাইছে। এরপর কেউ আর চিকিৎসা করায়নি।’
এ অবস্থায় এখন কী চাওয়া আছে তাঁর—জানতে চাইলে আমেনা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন দুইডা চোখের আলো ফিইরা পাইলে কোরআন শরিফ পড়তে পারতাম। এটাই চাওয়া। নিজের সন্তানই কারো খোঁজ নেয় না, আর আমার তো দত্তক সন্তান। মন আর খারাপ করি না।’
পাশের রুমেই শুয়েছিলেন ৯০-ঊর্ধ্ব সরিয়ম বেগম। জন্ম কলকাতায় হলেও বিয়ে হয় কুষ্টিয়ায়। এক ছেলে, এক মেয়ের জননী তিনি। ভাঙা ভাঙা শব্দে সরিয়ম বললেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের অনেক কষ্টে বড় করেছি। একসময় শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে পা ভেঙে যায়। পরে কুষ্টিয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় মেয়ে আমাকে লোক মারফত এখানে পাঠিয়ে দেয়। ছেলে ইন্ডিয়ায়, কখনো খোঁজ নেয় না। তাদের কথা মনে পড়ে, দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কী করব! তারা তো খোঁজ রাখেনি। এখন এইডাই (আপন নিবাস) আমার শেষ ঠিকানা।’
পাশের আরেক রুমে কথা হয় হালিমা আক্তারের সঙ্গে। বয়স কত জানতে চাইলে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘বয়স কত জানি না। তয় সংগ্রামের বছর (মুক্তিযুদ্ধ) বিয়া হইছে। তখন ১৬-১৭ বছর ছিল। ছেলেমেয়ে হয় নাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে আমাগো বাড়ি। স্বামী সরকারি চাকরি করত। মারা যাওয়ার পর কেউ আর খোঁজ নেয়নি। বাবার বাড়িতে ভাইয়েরা থাকলেও খোঁজ নেয়নি। তাদের জন্য খারাপ লাগলেও খোঁজ নেয় না। এখানেই যেন আমার মৃত্যু হয়, এটাই চাওয়া।’
হালিমা, সরিয়ম, আমেনার মতো অর্ধশত প্রবীণ মহিলা রয়েছেন এই বৃদ্ধাশ্রমটিতে। বয়সের ভারে রোগশোকে তাঁদের অনেকের মানসিক ভারসাম্য নেই। অনেকের পরিবার, সন্তান, সম্পত্তি থাকলেও নানা কারণে শেষ জীবনটা এখানে পার করতে বাধ্য হয়েছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, তিনতলা ভবনটির দোতলা ও নিচতলার পাঁচটি বড় রুমে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে-বসে ১০-১২ জন করে বৃদ্ধা। কেউ একে অন্যের মাথা আঁচড়ে দিচ্ছেন, কেউ বা অন্যের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, আবার কেউ করছেন চিৎকার। কেউ বা জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছেন।
বৃদ্ধাশ্রমটির কর্মী নাদিয়া হক জানান, সেখানকার বেশির ভাগ বৃদ্ধার মানসিক ভারসাম্য নেই। অনেকে আবার শারীরিকভাবে অসুস্থ। প্রতিদিন রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাওয়াতে হয়।
আরেকজন কর্মী অনিক হাসান জানান, এখানে আশ্রয় নেওয়া মা-বোনদের আমৃত্যু সেবা-যত্ন দেন তাঁরা। এখানে কারো মৃত্যু হলে নেওয়া হয় দাফনের ব্যবস্থা। এ পর্যন্ত এখানে ৮০ জন মারা গেছেন।
২০১০ সালে সমাজকর্মী সৈয়দা সেলিনা হক শেলীর উদ্যোগে ‘প্রবীণদের জন্য প্রত্যাশিত জীবন চাই’ শিরোনামে অসহায় বয়স্ক নারীদের জন্য যাত্রা শুরু আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের। সেলিনা হক বলেন, ‘ছোটখাটো দাতা ছাড়া আমাদের বেশির ভাগ সহায়তা একেক দিন একেকজন করেন। কষ্ট হলেও প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বৃদ্ধাদের নিয়ে আসতে আমাদের কাছে ফোন আসে। সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতায় অনেককে আনতে পারি না। যাঁদের একেবারে না আনলেই নয়, তাঁদের নিয়ে আসি।’