ঝড়ের কবলে পড়ে সাগরে ট্রলার ডুবি নিখোঁজ জেলে হাচানের প্রানে বেচেঁ ফেরার বর্নণা

received_603168057880902.jpeg

মো:ফিরোজ,বাউফল(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি:
বৈরী আবহাওয়ায় মাছ ধরতে গিয়ে গভীর সাগরে জাল ফেলি । জাল তোলার ঠিক এক ঘন্টা আগে ঘূর্নিঝড় শুরু হয়। আমরা সবাই ট্রলারে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ সাগরের উত্তাল ঢেউ ও প্রচন্ড ঝড়ে ট্রলারটি উল্টে যায়। আমরা সবাই ডুবন্ত ট্রলারের ভেসে থাকা কিছু অংশ আকড়ে ধরি। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ট্রলারের সঙ্গে আঘাত পেতে পেতে শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষত হয়ে যায়। তারপরেও বেচেঁ থাকার আশায় ট্রলার ছেড়ে দেইনি। এভাবে জীবন-মরন যুদ্ধ চলছিল বৃহস্পতিবার(১৮ আগষ্ট) সকাল থেকে ২২ আগষ্ট (রবিবার) বিকেল পর্যন্ত। এরপর ভারতীয় কোষ্ট গার্ড তাদেরকে উদ্ধার করে। একদিন ও রাত ভারতীয় কোষ্ট গার্ডের জাহাজে থাকার পর গত ২৩ আগষ্ট (মঙ্গলবার ) সকালে বাংলাদেশের কোষ্ট গার্ডের কাছে আমাদেরকে হস্তান্তর করে ভারতীয় কোষ্ট গার্ড। পরে বাংলাদেশের কোষ্ট গার্ড ওই দিন রাত ৯ টার দিকে মোংলা বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদারের কাছে হস্তান্তর করেন । সেখান থেকে স্বজনদের কাছে জেলেদেরকে হস্তান্তর করেন তিনি। আজ ৩০ আগষ্ট দুপুরে নিজ বসতঘরে বসে এভাবেই বেঁেচ ফেরার কথা বলছিলেন বৈরী আবহাওয়ায় সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ হওয়া জেলে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের মমিনপুর গ্রামের হাচান হাওলাদার(১৮) । কথা বলার সময় একমাত্র শিশু সন্তান হাবিবা তার কোলে এসে বসে এবং স্ত্রী জান্নাত পাশে এসে দাড়ায়। তিনি বলেন, ওই সময় শুধু আল্লাহর নাম স্মরন করতেছিলাম। তবে ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে ক্রমশ: দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এক সময়ে আল্লাহর নামটা মুখে বলার মত শক্তিও ছিল না। তাই বেচেঁ ফেরার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। আল্লাহতালা বাঁচিয়ে রেখেছেন এ জন্য শুকরিয়া আদায় করছি। তিনি বলেন, ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবন্ত ট্রলারটিন ভাসমান কিছু অংশ ধরে সবাই বৃহস্পতিবার সারা দিন ছিলাম। এরপর প্রচন্ড তুফানে মিলন খান(৪০), রিপন হাওলাদার(৩০) ও কালাম খান(৫৫) কে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে বৃহস্পতিবার (১৮ আগষ্ট) রাত কেটে যায়। শুক্রবার (১৯ আগষ্ট) সকালে সুলতান মোল্লাও তুফানে ভেসে যায়। বাকী ৯ জন ওই ভাবে শুক্রবার রাত পর্যন্ত থাকি। ট্রলার ধরে রাখার মত শক্তি না থাকায় শনিবার (২১ আগষ্ট)সকালে সাগরে তলিয়ে যায় বজলু হাওলাদার(৪০), ট্রলার মালিক মোঃ আলম গাজী(৫০) ও মোতাহার আকন(৪০)। চোখের সামনে তাদেরকে পানিতে ডুবে যেতে দেখেছি। ভাগ্যক্রমে আমিসহ ৬জন প্রানে বেচেঁ যাই। বেচেঁ যাওয়া অন্যরা হলেন, জলিল শরীফ(৩৫),নুর আলম(৪০), বাবুল মীর(৪৮),সবুজ খান(৩০) ও কাওছার রাড়ী(২৯)।
হাচানের স্ত্রী জান্নাত বেগম বলেন, নিখোঁজের খবর শুনে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। শুধু নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বলেছি, আল্লাহ তুমি আমার স্বামীকে জীবিত অবস্থায় আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আমার ঘরের আলো তুমি নিভিয়ে দিও না। আমার শিশু সন্তান হাবিবা কপালে হাত দিয়ে বলতো, আল্লাহ আমার আব্বাকে আইন্না(এনে) দ্যেও।
ট্রলার মালিক আলম গাজীর ভাই হাবিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের কোষ্ট গার্ডের মোবাইল ফোন দিয়ে উদ্ধার কৃতরা আমার সাথে মোবাইলে কথা বলেন। কোষ্ট গার্ডের মাধ্যমে জানতে পারি উদ্ধারকৃত জেলেদেরকে মংলা বন্দরে হস্তান্তর করা হবে। এরপর শহিদুল মুন্সি নামে আমার এক আত্মীয়কে মংলা বন্দরে পাঠাই।
শহিদুল মুন্সি বলেন, কেশবপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ মহিউদ্দিন আহম্মেদ লাভলু ভাই আমাকে মোংলাবন্দর উপজেলা নির্বাহি অফিসার কমলেশ মজুমদারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। আমি তার কথামত সেখানে চলে যাই। পরে উপজেলা নির্বাহি অফিসার আমাকে ডেকে উদ্ধারকৃত ছয় জেলেকে আমার কাছে হস্তান্তর করেন। পরে আমি একটি মাইক্রো গাড়ী যোগে বুধবার(২৫ আগষ্ট) দুপর ১২ টার দিকে মমিনপুর গ্রামে পৌছাই।
স্থানীয়রা জানান, ঝড়ের কবলে পড়ে ১৮ আগষ্ট বৃহস্পতিবার নিখোঁজ হওয়া ১৩ জেলের মধ্যে ৬ জন প্রানে বেচেঁ এলেও এখনও ৭ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এখনও কেউ কিছু বলতে পারছি না। নিখোঁজ রয়েছেন, মিলন খান, রিপন হাওলাদার, কালাম খান, সুলতান মোল্লা, বজলু হাওলাদার, মোঃ আরল গাজী ও মোতাহার আকন।
নিখোঁজ হওয়া জেলে আলম গাজীর ছেলে মোঃ নাঈম(১৮) কান্ন জড়িত কন্ঠে বলেন, নিখোঁজের খবর পেয়ে কান্নাকাটি করলেও বাবা ফিরে আসবে এই আসায় ছিলাম। কিন্তু দিন যত বাড়তে থাকে আমরা পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। ফিরে আসা জেলেদের মুখে যখন শুনি বাবা সাগরে তলিয়ে গেছেন ।তখন মনে করি বাবা আর ফিরে আসবে না। একই কথা বলেন নিখোঁজ হওয়া আরেক জেলে মোতাহারের ছেলে রিফাত(১৮)।
উদ্ধারকৃত জেলেদের হস্তান্তরের সত্যতা স্বীকরা করে মোংলা বন্দর উপজেলার নির্বাহি অফিসার কমলেশ মজুমদার বলেন, উদ্ধারকৃত জেলেদের রাতে থাকা এবং খাবারের ব্যবস্থা করে দেই। বাড়ী ফেরার জন্য মাইক্রোবাস ভাড়া করে দিয়ে আমার সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতা করেছি।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top