অস্তিত্ব সংকটে কালীগঞ্জের মৃৎশিল্প

received_274982165289939.jpeg

মো:ইব্রাহীম,কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি:

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় মৃৎশিল্প একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই শিল্পে উপজেলার জামালপুর ও বক্তারপুর ইউনিয়নের প্রায় ১৫০টি পরিবার এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। তবে যে কয়জন কারিগর কাজ করছেন তারা নানা প্রতিকুলতার মাঝে কোন রকমে টিকে আছেন। পনের বিশ বছর আগেও দৈনন্দিন নানা কাজে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ হারিয়ে যেতে বসেছে সুপ্রাচীন এ শিল্প। কারিগরদের দাবি, সরকারী বেসরকারী ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্প ফিরে পেতে পারে তার হারানো জৌলুস। সেই সাথে আয় হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা।

সরেজমিন জানা যায়, উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের নাওয়ান ও জামালপুর ইউনিয়নের নারগানা গ্রামে কুমার বা পাল সম্প্রদায়ের বসবাস। এই দুই এলাকাতেই প্রাচীনকাল থেকে পাল পাড়ায় কুমারদের বসবাস। বর্তমানে কালীগঞ্জে কুমার বা পাল সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫০ পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। মৃৎশিল্পীরা মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির পাশাপাশি সব ধরনের দেব দেবীর প্রতিমা তৈরিতে দক্ষ। হাত এবং চাকার সাহায্যে কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরির পর কাঁচা থাকতে তাতে কাঠি দিয়ে পাতা, ফুল, পাখি ও বিভিন্ন বৈচিত্রময় রেখার নকশা করা হয়। কখনো আবার দ্রব্যাদি পোড়ানোর পর এতে নানা রঙের আকর্ষণীয় নকশা করা হয়। এছাড়াও বাঁশ, খড়কুটা, মাটি, কাপড় ও রং দিয়ে নির্মিত তাদের মূর্তিগুলো এক একটি অসাধারণ শিল্প। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও মাটির তৈরি জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য আলাদা ঘরের অভাবসহ নানা কারণে মৃৎশিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে। তাই অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও যারা এখনো এই পেশায় আছেন, তারা মূলত পৈত্রিক এ পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে মৃৎশিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। তবে তারা ঠিকমতো সংসারই চালাতে পারছেন না।

মৃৎশিল্পের সাথে যুক্ত বক্তারপুর ইউনিয়নের নাওয়ান গ্রামের অমর্ত রানী পাল জানান, মানুষ শুধু আমাদের সাথে ছবি তুলতে আর ভিডিও করতে আসে। আমাদের জন্য কেউ কিছু করে না। বেশির ভাগ কুমারের পোড়ানোর জন্য পুনের ঘর না থাকায় কাঁচা জিনিসপত্র পোড়াতে সমস্যা হয়। একই এলাকার হরে কৃষ্ণ পাল বলেন, এ পেশায় থেকে জীবন ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, সংসার আর চলে না। আগের মতো মানুষজনের মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা নেই। যা আয় হয় তা দিয়ে ঠিকমতো খেতেই পারি না। তাই ভাবছি অটোরিকশা চালাব। তাতে করে আমাদের সংসার চলবে, কষ্ট কম হবে। নাওয়ান মোড় এলাকার ‘মা’ মৃৎশিল্প ষ্টোরের স্বত্ত¡াধীকারী শিশির পাল বলেন, মাটির তৈরী তৈজসপত্র এখন আর আগের মত চলে না। মায়ায় পড়ে বাবার আমলের পুরাতন ব্যবসা ছাড়তেও পারছিনা। বর্তমানে প্লাস্টিকের তৈরী জিনিসপত্রের ভিড়ে আমাদের এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। এ পেশায় থেকে পেটের খাবারটুকুই যোগাড় করা কষ্টকর।

জামালপুর ইউনিয়নের নারগানা গ্রামের সুমঙ্গলের স্ত্রী মৃৎশিল্পী সবিতা রানী পাল জানান, মাটি দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করে এখন আর লাভ হয় না। পূর্ব পুরুষদের প্রতি সম্মানের কারণে আমরা এখনো এ পেশা ধরে রেখেছি। সরকার আমাদেরকে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করে দিলে আমরা আমাদের কারিগরি দক্ষতা দ্বারা পূর্বের সুনাম ফিরিয়ে আনতে পারতাম।

নারগানা এলাকার সাবেক ইউ.পি সদস্য নিপেন্দ্র চন্দ্র পাল জানান, আমরা এখনো এ পেশা ধরে রেখেছি। কালীগঞ্জ মৃৎশিল্পের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে সিলভার, স্টিল, প্লাস্টিক, সিরামিক, চীনামাটির অত্যাধুনিক তৈজসপত্রের কারণে মৃৎশিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। এছাড়া মাটি, জ্বালানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। মৃৎশিল্পের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এছাড়াও বিদেশে রপ্তানীর ব্যবস্থা করতে পারলে দেশের অর্থণীতিতে আমরা গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারতাম।

মৃৎশিল্পের সাথে জড়িতদের বিষয়ে জানতে চাইলে বক্তারপুর ইউ.পি চেয়ারম্যান মো. আতিকুর রহমান আকন্দ ফারুক প্রতিবেদককে বলেন, মৃৎশিল্প একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। তবে পরিষদের পক্ষ হতে বিছু করার নেই। তবে তারা যদি সম্মিলিত ভাবে এম.পি মহোদয়ের কাছে সাহয্যের আবেদন করে তাহলে সরকারী সহযোগীতা পাওয়া সম্ভব। মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনই নানা উদ্যোগ নেওয়া জরুরী।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top