দিন প্রতিদিন :
বাকি বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের জলবায়ুও ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে তাপপ্রবাহ ও শৈত্যপ্রবাহের ওপর। বর্ষা মৌসুমে তাপপ্রবাহের প্রবণতা বেড়েছে, শীতকালে শৈত্যপ্রবাহ কমছে। দীর্ঘায়িত হচ্ছে গ্রীষ্মকাল, কমে আসছে শীতের ব্যাপ্তি।
এ ছাড়া সূর্যের আলোর উপস্থিতি, বৃষ্টিপাতের সময়, পরিমাণসহ আরো কিছু বিষয়েও পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন
১৯৮০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আবহাওয়ার প্রবণতা এবং পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের উল্লিখিত চিত্র উঠে এসেছে। দেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নরওয়ের আবহাওয়া সংস্থার যৌথ উদ্যোগে করা গবেষণাটি গতকাল মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে প্রকাশ করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ ও নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিভাগের প্রধান হনস ওলাফ হেইগেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও নরওয়ের ছয় সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞদল ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে গবেষণাটি করেছে।
এর আগে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও মেট নরওয়ে ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশের জলবায়ু’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই গবেষণার উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট স্থানের ভিত্তিতে জলবায়ুর কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে তা তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে দেখানো। আমরা দেখছি, মৌসুমের ধরনে (প্যাটার্ন) পরিবর্তন আসছে। গ্রীষ্ম দীর্ঘায়িত হচ্ছে, শীত সংক্ষিপ্ত হচ্ছে।
২০১০ সালের পর থেকে বর্ষা শুরু হতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে বর্ষা পিছিয়ে গেছে এমন সিদ্ধান্তে এখনই আসা যাবে না। এ নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন। এই গবেষণায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৩৫টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, সূর্যের আলো ও মেঘের উপস্থিতির তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চার দশকের বেশি সময়ের জলবায়ুর এই উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করা হয় এতে।
বড় পরিবর্তন তাপ ও শৈত্যপ্রবাহে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি তিন মাস বাংলাদেশের শীত মৌসুম। মার্চ থেকে মে তিন মাস প্রাক-বর্ষা মৌসুম। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম এবং অক্টোবর ও নভেম্বর বর্ষা-পরবর্তী মৌসুম।
বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে তাপপ্রবাহ ধরা হয়। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি বা এর নিচে নামলে ধরা হয় শৈত্যপ্রবাহ। গবেষণা বলছে, গত কয়েক দশকে শৈত্যপ্রবাহ কমে আসা ও তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়াটা জলবায়ু পরিবর্তনের এক স্পষ্ট সংকেত দিচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে তাপপ্রবাহের বিস্তৃতি বেড়েছে। এটি এই অঞ্চলের মৌসুমের ধরন পরিবর্তনকে ইঙ্গিত করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ক্ষেত্রে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে তাপপ্রবাহ শুরু হতো মার্চের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে। তবে ১৯৯৭ সালের পর থেকে এতে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেছে। তাপপ্রবাহের সময় পিছিয়ে চলে গেছে মার্চের তৃতীয় বা শেষ সপ্তাহে। এপ্রিল ও মে মাসের প্রায় পুরোটা সময়েই থাকছে তাপপ্রবাহ। ২০১০ সালের পর থেকে ঢাকায় বর্ষা মৌসুমেও তাপপ্রবাহ বেড়েছে। রাজশাহীতেও বর্ষা মৌসুমে তাপপ্রবাহ বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে এখানে তাপপ্রবাহ খুব অল্প সময় দেখা গেলেও ২০০৫ সালের পর থেকে তা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।
এ ছাড়া রংপুর, খুলনা বিভাগেও বর্ষা মৌসুমে তাপপ্রবাহের সংখ্যা বেড়েছে। বরিশালেও মে ও জুন মাসে বেড়েছে তাপপ্রবাহের দিন। সাম্প্রতিক সময়ে বরিশাল বিভাগে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসেও কিছু তাপপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। তবে চট্টগ্রামে তাপপ্রবাহের পরিমাণ তুলনামূলক কম বলে উঠে এসেছে গবেষণায়।
ঢাকায় জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি শৈত্যপ্রবাহ হতো। তবে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে। সার্বিকভাবেই শৈত্যপ্রবাহ কমে গেছে এই বিভাগে। রাজশাহীতে ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলেও ২০০৬ সালের পর থেকে শীত দেরিতে আসছে এখানে। ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে শৈত্যপ্রবাহ কমে বেড়েছে জানুয়ারিতে। উত্তরের আরেক বিভাগ রংপুরেও পিছিয়েছে শৈত্যপ্রবাহের শুরুর সময়। অন্যদিকে তাপপ্রবাহ ক্রমে দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
বর্ষায় বাড়ছে তাপমাত্রা
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে উষ্ণতর জলবায়ুর দিকে যাচ্ছে। ঢাকায় সব মৌসুমেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বর্ষার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে সারা দেশেই। বর্ষা মৌসুমে মেঘাচ্ছন্ন ভাব কমে যাওয়ায় দিনে বেশি গরম ও রাতে বেশি ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।
ঢাকার ক্ষেত্রে বর্ষা মৌসুমে প্রতি দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৩ ডিগ্রি। প্রাক-বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী সময়ে ০.১ ডিগ্রি করে বেড়েছে। তবে শীত মৌসুমে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমেছে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বাড়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী ও সিলেট। এ দুই অঞ্চলেই প্রতি দশকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৫ ডিগ্রি। বরিশাল ও খুলনায় বেড়েছে ০.৪ ডিগ্রি করে। রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে বেড়েছে ০.৩ ডিগ্রি করে। চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতি দশকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিভাগের প্রধান হনস ওলাভ হেইগেন বলেন, বাংলাদেশের জলবায়ুগত ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়, বরং উত্তপ্ত। ঢাকায় শীতকালেও তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকছে। বর্ষা মৌসুমে সব জায়গায় বৃষ্টি কমছে। বাংলাদেশের কৃষির জন্য বর্ষাকাল খুব জরুরি। সুতরাং এটা একটা চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের মূল সময় বর্ষা মৌসুম। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক হওয়ায় তা অনেকাংশেই নির্ভরশীল বর্ষার বৃষ্টির ওপর। বৃষ্টিপাতের সময়ের কিছুটা পরিবর্তন হলেও পরিমাণ খুব বেশি কমেনি। বর্ষা মৌসুমে রংপুর বিভাগে প্রতি দশকে বৃষ্টিপাত কমেছে ১০৫ মিলিমিটার। এর পরই রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ। এখানে বৃষ্টি কমেছে ৫৮.৩ মিলিমিটার। ঢাকায় বর্ষা মৌসুমে প্রতি দশকে বৃষ্টি কমেছে ১৯.৩ মিলিমিটার। দিনের হিসাবে বৃষ্টিপাতের দিন সবচেয়ে বেশি কমেছে ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে, ২.৭ দিন করে।
শীতকালে কমেছে সূর্যের আলো
দেশের প্রায় সব বিভাগেই শীতকালে সূর্যালোকের সময় কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এর মধ্যে গত ৪০ বছরে সূর্যালোক সবচেয়ে বেশি কমেছে রংপুর বিভাগে। এই বিভাগে প্রতি দশকে সূর্যের আলো দেওয়ার সময় ০.৯ ঘণ্টা করে কমেছে। এর পরই রয়েছে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগ। এই তিন বিভাগে প্রতি দশকে সূর্যের আলোর ব্যাপ্তিকাল কমেছে ০.৮ ঘণ্টা।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, শীতে বায়ুদূষণ ও ধূলিকণা কুয়াশা তৈরিতে সাহায্য করে। ধূলিকণা যেখানে বেশি সেখানে কুয়াশাও বেশি। ফলে দিনের বেলা সূর্যের আলো কম প্রবেশ করায় তাপমাত্রাও কম থাকে।