লেখক:সিরাজউদ্দিন আহমেদ
নমিতা বলল, আমরা তাজমহল দেখতে যাব। আমি বিব্রত বোধ করি। নমিতা আমার নববধূ। দুদিন হয় বিয়ে হয়েছে। নমিতার স্বপ্ন, তাঁর এই উদ্ভাসিত আনন্দ ম্লান হয়ে যাক তা চাই না। নমিতার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে মৃদু স্বরে বলি, যাব, নিশ্চয়ই যাব। হাতে কিছু টাকা জমুক। নিশ্চয়ই তাজমহল দেখতে যাব।
নমিতা অবাক হয়ে বলল, ওমা, তুমি কি আগ্রার তাজমহলের কথা বলছ? আমাদের গ্রামেও একটা তাজমহল আছে। সেখানে আজ বিকেলে তোমাকে নিয়ে যাব। সেটা আগ্রার তাজমহলের মতো না হলেও একেবারে আলাদা।
নমিতা আমার কাছে সরে এলো। মৃদু স্বরে বলল, তাজমহলের কথা শুনে তোমার মুখ কালো হয়ে গেল। আমাকে কি এত অবিবেচক মনে হয়? তোমার এ অবস্থায় আমি তাজমহল দেখার বায়না করব। হঠাৎ করে আমাদের বিয়ে হলো। তোমার আত্মীয়-স্বজন কেউ জানে না। কত কথা শুনতে হবে। কত ঝড়ঝাপটা যাবে। সব কিছুর জন্য আমি তৈরি হয়ে আছি। তুমি একদম টেনশন করবে না।
নমিতার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা অনুভব করি।
আমি পেইন্টার। বয়স চব্বিশ। চারুকলার ছাত্র ছিলাম। পড়াটা শেষ করতে পারিনি। রোজগারের জন্য ছবিটবি আঁকি। বেশির ভাগ ওয়াটার কালার ল্যান্ডস্কেপ। চারুকলার ফুটপাতে ছবি সাজিয়ে দাঁড়াই। শাহবাগ ধানমণ্ডির কয়েকটি দোকানে পেইন্টিং দেওয়া আছে। বিক্রি খারাপ হয় না।
ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে আমি মাঝেমধ্যে ঢাকার আশপাশের গ্রামগুলোতে যাতায়াত করি। রথমেলার ছবি আঁকতে আমি ধামরাই চলে গেলাম। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। রথের চারপাশে মেলার আঙিনায় সার্কাসের হাতি-ঘোড়ায় জনমানুষে জলে-কাদায় একাকার। আমি ব্রিজ পার হয়ে চলে গেলাম কুমারপাড়ায়। নদীর ধারে একটা নিরিবিলি জায়গায় দিনভর ছবি আঁকলাম। বিকেলবেলা ক্ষুধায় কাতর হয়ে কাছেই একটা টঙের দোকানে গেলাম খেতে। কলা পাউরুটি চা খাচ্ছি, দোকানদার জিজ্ঞেস করল, ঢাকা থেইকা আইছেন? মনে হয় ঢাকায় আইজ ফিরতে পারবেন না। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। গাবতলীর দিকে কী নাকি গোলমাল হইছে।
তাহলে উপায়? আকাশে ঘন কালো। যেকোনো সময় মুষলধারে বৃষ্টি হবে।
ভাই, এখানে আজ রাতটুকু থাকার মতো কোনো ব্যবস্থা আছে? কোনো হোটেল বা অন্য কিছু…।
গ্রামে-গঞ্জে হোটেল পাইবেন কই? আপনে এক কাজ করেন, সুবল পালের বাড়ি চলে যান। তারা ভালো মানুষ। শিক্ষিত মানুষের কদর বুঝে। সে সাহায্য করতে পারে।
আকাশ ঘন কালো, জোর বাতাস বইছে। লোকটি দোকান বন্ধ করতে করতে বলল, দোকান বন্ধ কইরে আমি বাড়ি যাব। আপনি রওনা হইয়া যান।
সুবল পালের বাড়ি আমি চিনব কী করে?
ওই যে নারকেলগাছঅলা দোতালা বাড়িটা দেখতাছেন, ওইটা সুবল পালের বাড়ি।
আমার ছবি আঁকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে দ্রুত পায়ে প্রায় দৌড়ে দোতলা বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজা খুলে একজন তরুণী বলল, বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন? ভেতরে এসে বসুন।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। আমাকে বলছেন?
মেয়েটি হাসল, আপনি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই।
বাতাসে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে। আমি ছবি আঁকার সরঞ্জাম ঘরের এক কোণে রেখে মেয়েটির দিকে তাকালাম।
আমি স্বপ্নে মাঝে মাঝে একটি মেয়েকে দেখি। মেয়েটির চেহারা মনে নেই। মেয়েটি কোমল গলায় আমাকে নির্দেশ করে। আমি নীরবে পালন করি। মেয়েটি কি আমার স্বপ্নে দেখা তরুণী, যাকে আমি চিনি না কিন্তু নির্দেশ পালন করি?
দুকাপ চা নামিয়ে রেখে বলল, নিন, চা খান। আপনি আর্টিস্ট?
আমি পেইন্টার। ছবি আঁকি।
ভাবলাম এই সুযোগে আমার বিপদের কথাটা বলি। আমি বলতে যাব, অমনি মেয়েটি বলল, আপনার তো বিপদ হলো। এই বৃষ্টিতে ফিরবেন কী করে?
আমি শঙ্কিত গলায় বললাম, তা-ই তো ভাবছি।
মেয়েটি বলল, আপনার যাওয়া হবে না। আকাশের অবস্থা দেখেছেন? এই বৃষ্টি থামার নয়।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তাহলে?
মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, দুশ্চিন্তার কী আছে! যেতে না পারলে থেকে যাবেন।
আমি চমকে উঠি, কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে? একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে মেয়েটি চেনা মানুষের মতো কথা বলছে। গ্রামের একটি মেয়ের এমন দ্বিধাহীন নিঃসংকোচ আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে। ভয়ও করছে। কোনো বিপদ হবে না তো?
বারান্দায় বেরিয়ে বৃষ্টির গতিবেগ দেখে হতাশ হলাম। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। মেয়েটি বলল, বারান্দায় দাঁড়ালে ভিজে যাবেন। ঘরে এসে বসুন। আমার জন্য কি আপনি অস্বস্তি বোধ করছেন?
সহজ হতে চেয়ে আমি মৃদু হাসলাম, না। তা হবে কেন! বাসায় কে কে আছেন?
মেয়েটি বলল, বাবা গত হয়েছেন। আমার তিন দাদা। দাদারা বাইরে আছেন। বাসায় বউদি আছেন, মা আছেন। কথা বলবেন?
মেয়েটির দিকে সাহস নিয়ে তাকাই। ভারি মিষ্টি তো মেয়েটি! প্রতিমার মতো। তাকিয়ে থাকলে হৃদয়ে কাঁপন জাগে। চোখ সরিয়ে আকাশ দেখি। মেয়েটির দিকে তাকাতে ভয় হয়। প্রথমত মেয়েটি সুন্দরী। দ্বিতীয়ত রহস্যময়ী।
একা থাকতে ভয় পাবেন না তো? মেয়েটি নিঃশব্দে হাসল। আমি ভেতরবাড়ি যাচ্ছি। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। আমার নাম নমিতা।
নমিতা দ্রুত বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কতক্ষণ আর একনাগাড়ে বসে থাকা যায়। আমি উঠে পায়চারি করলাম। ভেতরবাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। তারপর বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। অসহায় বন্দির মতো আকাশে তাকিয়ে রইলাম।
বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন যে!
আমি এত চমকে উঠলাম যে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সভয়ে নমিতার দিকে ফিরে তাকালাম। নিঃশব্দে কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আগে কামিজ পরে ছিল, এখন দেখছি শাড়ি পরেছে। কিছু সাজসজ্জাও করেছে। কপালে টিপ দিয়েছে। চোখে কাজল।
স্যরি! আমার মনে হলো আপনি এই বৃষ্টির মধ্যে চলে যেতে পারেন। তাই সাবধান করতে এলাম। এই কাজ করবেন না। বিপদে পড়বেন। দেখছেন না কেমন ঝুম বৃষ্টি।
ভবিষ্যদ্দ্রষ্টার মতো কথাগুলো বলে রহস্যময়ী নমিতা বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমার আস্থা দুর্বল হতে থাকে। নমিতা আমার মনের কথা জানল কী করে? পালাতে চাই। ভয় আরো বেড়ে গেল।
আঁকা ছবি ও ছবি আঁকার সরঞ্জাম রেখে প্রবল বর্ষণের মধ্যে পথে নেমে এলাম। তীব্র বৃষ্টির তীক্ষ ফোঁটা আমার শরীরে বিঁধছে। প্রবল হাওয়া আমার গতি টেনে ধরেছে। এসব উপেক্ষা করে প্রাণপণে এগিয়ে যাচ্ছি। তিনজন লোক আমার গতি রোধ করে দাঁড়াল। মনে হলো, এরা নমিতার তিন দাদা। আমাকে ধরতে এসেছে। আমাকে পালাতে হবে। আমি যত দ্রুত পালাতে চাই, পা পিছলে বারবার পড়ে যাই।
নমিতা ওদের বাড়ি আমাকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। বাড়ির এক পাশে বিশাল দোচালা ঘর। সেখানে নানা আকারের দেব-দেবীর মূর্তি।
এগুলো কে বানিয়েছে?
আমার দাদারা। আমিও বানাতে পারি। মূর্তি বানাতে দাদাদের সাহায্য করি।
কী সুন্দর নিখুঁত মূর্তি বানাও তোমরা! আমাকে শেখাবে?
শেখাব।
দুর্গাদেবীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি মুগ্ধ হলাম। তারপর অভিভূত বিস্মিত, অবশেষে আতঙ্কিত। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, নমিতা…।
নমিতা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, কী হয়েছে?
আমি দুর্গাদেবীর দিকে আঙুল নির্দেশ করি, দ্যাখো, তোমার মতো দেখতে। অবিকল তোমার মতো। তুমি দুর্গা!
হ্যাঁ, আমি। আমিই তো। আমিই দুর্গা।
লক্ষ্মীর দিকে তাকাই। প্যাঁচা কোলে নমিতা। আমাকে বোকা বানাতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসছে। কালীর দিকে তাকাতে আমার ভয় হয়। দুহাতে আমি চোখ লুকিয়ে রাখি। নমিতাকে কালীরূপে আমি দেখতে চাই না।
নমিতা বলল, কী হলো, আমাকে দেখবে না? আমি যেমন প্রলয়, তেমনি সৃষ্টিও করি। সৃষ্টিতে তুমি পাশে থাকবে, প্রলয়ে কেন থাকবে না। তাকাও, দেখো।
আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম। নগ্ন নমিতা আমার বুকে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ক্রুদ্ধ খড়্গ। কামড়ানো জিভে অনুতাপের চিহ্ন। আমি জ্ঞান হারালাম। কেউ বলল, তাড়াতাড়ি যাও। ডাক্তার নিয়ে এসো।
আমার কী হয়েছিল?
নমিতা বলল, আজ দশ দিন পর ঘর থেকে বেরোলে। তুমি অসুস্থ ছিলে। কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান হারাচ্ছিলে।
তুমি কি ডাক্তার? জ্বরের ঘোরে তোমাকে একবার দেখেছি। আমার জ্বর দেখছ। ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছ।
নমিতা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি নার্স। দুদিনের মধ্যে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তোমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে।
আমি নমিতার হাত ধরি, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না, প্লিজ।
পরদিন নমিতার সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। বিকেল হতে নমিতার সঙ্গে রিকশায় তাজমহল দেখতে রওনা হলাম। তাজমহল দেখার চেয়ে নমিতার সঙ্গে রিকশায় ঘনিষ্ঠ ভ্রমণ আমার কাছে অনেক আনন্দের ও রোমাঞ্চকর ছিল। নমিতা অন্যমনস্ক, চিন্তিত। আমার রোমাঞ্চ তাকে স্পর্শ করল না। ভিন্ন উত্তেজনায় সে উদগ্রীব হয়ে আছে।
চারদিকে তাকিয়ে আমি হতাশ হলাম, এই তোমার তাজমহল! এটা দেখার জন্য কত কথা, কত আয়োজন!
নমিতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল, এসো।
আমি নমিতার পিছু পিছু প্রবেশ করলাম। এক পাশে ঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উঠান। অন্য পাশে পাশাপাশি দুটি কবর। একটি বদ্ধ, অন্যটি খোলা। কবরের ওপর সবুজ কাপড়ের শামিয়ানা টানানো। পাশে সাদা দাড়ি-গোঁফে জট-পাকানো সুদর্শন এক বৃদ্ধ প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছেন। আমাদের পদশব্দে চোখ মেলে তাকালেন। নমিতা ছুটে গেল। পায়ের কাছে মিষ্টির প্যাকেট ও ফুল রেখে প্রণাম করল।
বাবা, আমরা বিয়ে করেছি।
আলহামদুলিল্লাহ!
বাবা, আপনি যা বলেছেন সব সত্যি হয়েছে!
কী বলেছি কিছুই মনে নেই রে, মা।
পায়ের কাছে মাথা রেখে নমিতা ডুকরে কেঁদে উঠল।
কাঁদছিস কেন?
বাবা, আমরা সুখী হব তো? আমার বড্ড ভয় করছে। ও মুসলমান, আমি হিন্দু। সবাই বিয়েটা মেনে নেবে তো? ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?
কে যে কিসে সুখী, তা যে ভীষণ জটিল রে, মা। তবে তোর বর তোকে খুব ভালোবাসবে। তোকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তোকে হারিয়ে খুঁজে বেড়াবে জগত্ময়…।
এই সব বুজরুকি আমার ভালো লাগে না। নমিতা কষ্ট পাবে ভেবে আমি নীরব থাকি। নমিতার মন ভার হয়ে আছে। রাতে শোবার আগে নমিতাকে হাসিখুশি লাগছে, তখন জানতে চাইলাম, দুটি কবর দেখলাম। একটি খোলা, অন্যটি ঢাকা। এর রহস্য কী?
নমিতা বলল, ঢাকা কবরে শায়িত আছেন মমতাজ বেগম। খোলা কবরে ঘুমান শাহজাহান। বিকেলে যাঁর কাছে আমরা গিয়েছিলাম, মৃত্যুর পর মমতাজ বেগমের পাশে তাঁর কবর হবে। তাই আমরা এই মাজারকে বলি তাজমহল।
সকালবেলা নমিতা বলল, মমতাজ বেগম শাহজাহানের স্ত্রী ছিলেন না। প্রেমিকা ছিলেন। যুবক বয়সে তিনি মমতাজকে নিয়ে সুদূর আগ্রা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। মমতাজ বেগমের স্বামীর কর্মচারী ছিলেন শাহজাহান। ধনী ব্যবসায়ীর স্ত্রী প্রেমিকা মমতাজকে নিয়ে পালালেন শাহজাহান। প্রতিশোধের স্পৃহায় মালিকের লোক পিছু নিল। পালাতে পালাতে অবশেষে আগ্রা থেকে ধামরাই এসে ঠাঁই মিলল। সংসার করার জন্য বাড়ি বানালেন। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হলো। কিন্তু বিয়েটা হলো না। ঠিক বিয়ের মুহূর্তে মালিকের লোক প্রতিশোধ নিতে আগ্রা থেকে ধামরাই এসে হাজির হলো।
সিনেমার মতো হয়ে গেল না?
সাপের কামড়ে মমতাজ বেগম মারা গেলেন। বাসরশয্যার জন্য যে ঘর সাজানো হয়েছিল, সেই ঘরে মমতাজের কবর দেওয়া হলো। কবরের পাশে শয্যা নিলেন শাহজাহান। সারা দিন দোয়া-দরুদ পড়েন। কবরের পরিচর্যা করেন। আপনমনে একাকী কথা বলেন। রাত হলে কবরের পাশে শুয়ে থাকেন। এভাবে কেটেছে চল্লিশ বছর।
অনেকক্ষণ নীরব থেকে নমিতা জিজ্ঞেস করল, তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করো?
আমি বললাম, না। আমি কর্মে বিশ্বাস করি।
আমিও করতাম না। শাহজাহান দাদুর ঘটনা আমাদের কয়েকজন বান্ধবীকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। আমরা দাদুর জন্য ফলমূল নিয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর মাজারে যেতাম। দাদুর মন ভালো থাকলে তাঁর জীবনের গল্প শোনাতেন। একদিন হাত বাড়িয়ে আমি বললাম, দাদু, আমার ভাগ্যে কী আছে বলেন দেখি।
দাদু বললেন, আমি হাত দেখতে জানি না, মা।
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে চমকে উঠলেন, তোর মনে এত কষ্ট কেন রে?
দাদুর কথা শুনে আমার দুচোখ জলে ভরে গেল। তোমাকে তো বলেছি, আমি ছিলাম লগ্নভ্রষ্টা মেয়ে। আমাদের সমাজে লগ্নভ্রষ্টা মেয়ের বিয়ে হয় না।
দাদু হেসে বললেন, চোখে পানি কেন রে? তোর বিয়ের ফুল ফুটেছে। বিশ বছর বয়সে তোর বর তোকে খুঁজতে খুঁজতে তোর বাড়ি এসে হাজির হবে।
তুমি যেদিন আমাদের বাড়ি এলে, সেদিন ছিল আমার বিশতম জন্মদিন। বাকি ঘটনা তুমি জানো।
নমিতা আমার দিকে গভীর বিশ্বাস নিয়ে তাকাল। নমিতার বিশ্বাসে আমি কোনো আঘাত করতে চাই না। মৃদু হেসে নমিতার হাতে আমার বিশ্বাস রাখলাম। এক মাস পর আমি ঢাকায় ফিরলাম।
পালপাড়া গ্রামটি আমার ভালো লেগে গেল। গাছগাছালিঘেরা নদীর ধারে গ্রাম। আমি ও নমিতা ঠিক করেছি, এই গ্রামে আমরা স্থায়ী হব। ঢাকার কাছাকাছি। আমাদের বড় স্টুডিও হবে। আমি ছবি আঁকব। নমিতা মূর্তি বানাবে। সুখের ছবি এঁকে আমি ঢাকায় ফিরে এলাম।
ঢাকার পাট চুকিয়ে আমার এবার স্বপ্নের ঠিকানায় ফেরা। নমিতার কাছে। গোছগাছ করতে দিন পনেরো কেটে গেল। দোকানে দোকানে ঘুরে আমার ছবি বিক্রির টাকা জোগাড় করলাম। এর মধ্যে অনেক পরিশ্রম করে সময় নিয়ে নমিতার একটি পোর্ট্রেট এঁকেছি। আমার আঁকা প্রথম পোর্ট্রেট। নমিতার বিষণ্ন মুখ। আমি যতবার আঁকতে বসেছি নমিতার সুখী মুখচ্ছবি, এই দুঃখী মুখটি বারবার ভেসে উঠেছে।
মহা আনন্দে আমি ধামরাই ফিরে এলাম। পালপাড়ার যত কাছাকাছি আসছি, আমার বিরহ যাতনা তত বেড়ে যাচ্ছে। ওইতো রথখোলা, রথ দাঁড়িয়ে আছে। রথ পেরিয়ে নদী। নদীর ওপর ব্রিজ। ব্রিজ পার হয়ে ওপারে টঙের দোকান। ওই দোকানে আজও আমি চা খাব। দোকান থেকে নমিতাদের দোতলা বাড়ি দেখা যায়।
ব্রিজ পার হয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। টঙের দোকানটি নেই। সেখানে পাকা একতলা দালান। বড় একটি মনিহারি দোকান। দোকানের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে একটি টঙের দোকান ছিল?
লোকটি বলল, পাঁচ বছর ধরে দোকান করছি। এখানে কোনো টঙের দোকান দেখিনি।
আমি দ্বিধায় পড়ি। কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে? পালপাড়াটা কোন দিকে?
একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে প্রথম যে রাস্তা গেছে, ওটা ধরে এগিয়ে গেলে পালপাড়া পাবেন।
আমার মনে আছে, ডান দিকে গিয়েছিলাম। ডান দিকে একটিমাত্র দোতলা বাড়ি। ওইতো ওই বাড়ি। নারকেলগাছগুলো হাওয়ায় দুলছে। আমার ভেতর উত্তেজনা টগবগ করে ওঠে।
আমার ডাকাডাকিতে একজন তরুণ বেরিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন?
তরুণটি ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের চোখে আমাকে দেখল, আপনে কে?
আমি? আমাকে চিনতে পারছেন না! এটা নমিতাদের বাড়ি?
হ্যাঁ, নমিতাদের বাড়ি।
আপনারা তিন ভাই। নমিতা আপনাদের একমাত্র বোন।
ঠিক আছে।
নমিতাকে ডাকেন। সে চিনতে পারবে।
তরুণটি বাড়ির ভেতর গেল নমিতাকে ডাকতে।
ফিরে এলো তিন ভাই।
ছোট ভাই বলল, দাদা, লোকটা বদ মতলব নিয়ে এসেছে। একটু শিক্ষা দিয়ে দিই।
বড় ভাই ছোটকে থামিয়ে বলল, কারে চান?
তিন ভাইয়ের শরীর-স্বাস্থ্য দেখে সভয়ে বললাম, নমিতার সঙ্গে কথা বলতে চাই। সে আমাকে চেনে।
নমিতা আছে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করছে। আপনার কোনো ভুল হইছে।
আমি বিভ্রান্ত বোধ করি। সব কিছু এলোমেলো লাগছে। নিজের কাছে নিজেকে অচেনা মনে হয়।
এটা পালপাড়া না?
পালপাড়া বড় রাস্তার বাঁ দিকে।
পালপাড়ায় নমিতাকে খুঁজে পেলাম না। তাজমহল খুঁজে হয়রান হলাম। শাহজাহানের আস্তানা খুঁজলাম। মাজার খুঁজলাম। সারা দিন খুঁজে ফিরলাম। কেউ চেনে না। কেউ বলতে পারে না। আমি কোথায় পাব তারে? আমার মমতাজ? আমার তাজমহল? একজন বলল, তাজমহল খুঁজছেন? শাহজাহানকে চান? আগ্রায় যান। কয়েকজন আড্ডাবাজ ছেলে বলল, কয় ছিলিম টানছেন? ধামরাই এসেছেন তাজমহল খুঁজতে!
তিন মাস আমি ধামরাই কাটালাম। কোথায় ভুল হয়েছে আমি খুঁজে বেড়াই। যা কিছু ঘটেছে, তা কি শুধু স্বপ্ন! আলোছায়ার কল্পকাহিনি? নাকি অচেতন জাগরণের মাঝে কোনো ধ্রুব সত্য লুকিয়ে আছে, যা আমি বিস্মৃত হয়েছি? নাকি এ আমার এক জীবনের ভেতর আরেক জীবন? ভিন্ন এক জীবন। সে জীবনে নমিতা ছিল। সে জীবন আমি বিস্মৃত ছিলাম। এক ঘনঘোর বর্ষায় আমার বর্তমান জীবনের মাঝে জেগে উঠেছে আমার ভিন্ন জীবন। স্মৃতির সুবাস দিয়ে আবার সে অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। তাকে আমি খুঁজে ফিরছি। কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ রে?
আমার আঙুলে নমিতার দেওয়া আংটি যখন দেখি মনে হয়, আমি সঠিক পথে আছি। নমিতা আছে। নমিতা কোনো কল্পকাহিনির গল্প নয়। স্মৃতি ফিরে পেলে নমিতাকে ফিরে পাব কিংবা নমিতাকে পেলে আমার স্মৃতি ফিরে আসবে।
আমার আর ঢাকায় ফেরা হয়নি। ছবি আঁকা ভুলে গেছি। বাংলাদেশের নানা জায়গায় আমি নমিতাকে খুঁজে ফিরেছি। দশ বছরে বাংলাদেশের তিরিশটি জেলার সব পালপাড়ার নমিতাকে খুঁজেছি। তেষট্টিজন নমিতা পালের দেখা পেয়েছি। তারা কেউ আমার নমিতা নয়।
চুল-দাড়ি-গোঁফে আমাকে এখন সাধুসন্তর মতো দেখায়। ধামরাইয়ের পালপাড়ার নমিতাকে আমি কুমিল্লার এক গ্রামে খুঁজে পেয়েছি। আমাকে দেখে বলল, আপনার কথা আমি শুনেছি। দাদারা বলেছে, একটা পাগল নমিতার খোঁজে তোর কাছে আসতে পারে। নমিতা আমাকে প্রণাম করল। তিন ছেলে-মেয়েকে আমার কাছে ডেকে আনল। থালায় করে মিষ্টি খেতে দিল। আঁচলে চোখের জল মুছে বলল, বাবা, আমার মন বলছে আপনার নমিতাকে ফিরে পাবেন।
সূত্র: কালের কন্ঠ