স্টাফ রিপোর্টার:-ইমদাদুল ইসলাম:-
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিতকরণে অবিরাম কাজ করায় প্রশংসায় ভাসছেন হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ রফিকুল ইসলাম। তাঁর উদ্ভাবনী ধারণা, ক্ষুদ্র উন্নয়ন পরিকল্পনা, সহযোগিতামূলক মনোভাব ও সৃজনশীল একজন শিক্ষা অফিসার হিসেবে সুশীল মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছেন। শিক্ষকদের কাছেও তিনি একজন একাডেমিক লিডার। শিক্ষার্থীদের কাছে বন্ধু মতো। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ রফিকুল ইসলাম সাথে বললে জানান যে, প্রাথমিকের শিশুদের জন্য কাজ করতে ভালো লাগে। দেশকে কিছু দেয়ার অন্যতম ক্ষেত্র হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। বৈচিত্র্যময় শিশুদের জন্য বৈচিত্র্যময় উদ্যোগ নিতেই হয়। উপজেলা শিক্ষা অফিসার জাকিরুল ইসলাম ও হবিগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার গোলাম মাওলাও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
মাধবপুরে সরকারি শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান,
শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধে, বিজ্ঞানমনস্কতায়, সৃজনশীলতায় ও উন্নত জীবন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। প্রকৃতি পরিবর্তিত পৃথিবীতে খাপ খাইয়ে চলার পথকে সুগম করে তোলা। বিশ্বায়নের এই সময়ে প্রতিটি শিশুকে স্মার্ট ও বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জ্ঞান বিজ্ঞান, গাণিতিক যুক্তি ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে সহজ ও আনন্দঘন পাঠ উপস্থাপন করতে হবে। শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য নিম্নোক্ত উদ্যোগ, উদ্ভাবনী ধারণা ও ক্ষুদ্র উন্নয়ন পরিকল্পনা কাজ করছে।
রফিকুল ইসলাম এর শিশুদের বিকাশে আমার আয়নায় আমি সুন্দর,আমার স্বপ্ন,আদর্শলিপি ক্যাম্প ও ইকো ক্যাম্প কনসেপটি শিক্ষা মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার সাথে আলাপচারিতায় এগুলো সম্পর্কে ব্যাপক বর্ণনা পাওয়া গেল।
ক. আমার আয়নায় আমি সুন্দর
শিশুর নান্দনিকতা বোধের উন্মেষ করার ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের একটি কার্যকর ইনোভেশন হলো আমার আয়নায় আমি সুন্দর। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর ৮০% ৮৫% শিশুই প্রান্তিক পরিবার থেকে আসে। বেশিরভাগ সময় শিশুরা বাড়ি থেকে না খেয়ে স্কুলে চলে আসে। চুল আঁচড়ায় না। ময়লা ও ছেঁড়া শার্ট বা জামা পরে আসে। হাত পায়ের নখ বড় হয়। তাই প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে ০১টি করে আয়না স্থাপন করা হয়। যেখানে নির্ধারিত একজন গাইড টিচারের নেতৃত্বে এই কার্যক্রম চলে। প্রথম দিকে লজ্জা পেলেও এখন তারা দল বেঁধে চুল আঁচড়ায়। একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করে। এছাড়াও গাইড টিচার কারো হাতে আঙুলের নখ বড় থাকলে নিজেই নেইল কাটার দিয়ে কেটে দিবেন।
আমার আয়নায় আমি সুন্দর
ইনোভেশনের ফলে শিশুরা নিজেদেরকে সুন্দর ও পরিপাটি দেখতে চায়। আয়নার ওপরে অংশে লেখা আছে দেখো- তুমি কত্তো সুন্দর। আয়নায় শিশু নিজেকে দেখে নিজের সৌন্দর্য আবিষ্কার করবে। নিজেকে পরিপাটি রাখবে। এককথায় বলা যায়” প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম একটি লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে নান্দনিকতার উন্মেষ ঘটানো।আয়নার ঠিক নিচে লেখা আছে” আয়না দেখে আঁকবো সিঁথি /থাকবো মোরা পরিপাটি।
খ. আমার স্বপ্ন-
প্রাথমিকের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে কিছু জানে না। বলতে পারে না বড় হয়ে তারা কী হবে? তাই প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ডের ঠিক ওপরে অংশে ‘আমার স্বপ্ন ব্যানার’ স্থাপন করতে হবে। ক্যাচমেন্ট এলাকার যাঁরা প্রসিদ্ধ পেশায় নিযুক্ত তাঁদের ছবি (একজন ডাক্তারের নাম ও ছবি) দিবেন।
প্রথম ধাপে, সংশ্লিষ্ট ক্যাচমেন্ট এলাকার একজন ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, বৈমানিক, শিক্ষক, কৃষক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌবাহিনী, আইটি বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি পেশাজীবীদের ছবি দিয়ে ব্যানার করে ব্ল্যাক বোর্ডের ওপর স্থাপন।
দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষকগণ উপর্যুক্ত পেশা সম্পর্কে ক্লাসে ০৫ মিনিট উপস্থাপনের সুযোগ করে। সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্লাসের শিক্ষার্থীদেরকে পেশাভিত্তিক দল গঠন করবে। যেমনঃ ডাক্তার দল।
তৃতীয় ধাপঃ পেশাভিত্তিক দল গঠন করা হলে দলের সকল সদস্যদের অংশগ্রহণে ৫-১০ মিনিটের একটা নাটিকা উপস্থাপন করবে।
এই ইনোভেশনের ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থী তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করবে। দলীয় কাজ উপস্থাপন করার ফলে শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, সহযোগিতামূলক মনোভাব এবং শিশুরা উন্নত জীবন দর্শনে উদ্বুদ্ধ হবে।
গ. আদর্শলিপি ক্যাম্পঃ
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় ৬০% শিক্ষার্থী বাংলা সাবলীলভাবে পড়তে পারে না। তাই শিক্ষার্থীদের পঠন ঘাটতি চিহ্নিত করতে বেইস লাইন সার্ভে এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণের জন্য পরিকল্পনা করা হয়।
বিশেষ করে নির্ধারিত সময়ের বিষয়ভিত্তিক পাঠদান চলাকালের শুরুতেই ০২ মিনিট এবং ক্লাস শেষে বের হওয়ার আগে ০২ মিনিট সরব পাঠ করাবেন। এভাবে প্রতিদিন ০৫/০৬ টি বিষয়ের শিক্ষকগণ একই পদ্ধতিতে সরব পাঠ করবেন। বর্ণের সাথে কারচিহ্ন ব্যবহার করলে যে যৌগ স্বর উচ্চারিত হয়- তা শিশুদেরকে শেখানো। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধ্বনি সচেতনতা সৃষ্টি করতে যেমনঃ কা, কি, কী, কু, কূ, কৃ, কে, কৈ, কো ও কৌ। এই লেখাটি ঐদিন ৩য়-৫ম শ্রেণির ব্ল্যাকবোর্ডে লেখাটি স্পষ্টাক্ষরে লেখা থাকবে।
এই পদ্ধতিতে শিক্ষকগণকে শিক্ষার্থীদের ধ্বনি সচেতনতা সৃষ্টি করার ফলে শিক্ষকগণ ক্লাসের বাইরে আলাদা সময় দিতে হবে না। ৩১ দিন এই ধ্বনি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রণীত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
ঘ. ইকো ব্রিকসঃ
ইকো ব্রিকস ধারণাটি নতুন হলেও তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। যে হারে পরিবেশ দূষণ চলছে, তাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশংকা বাড়ছে। মানুষ প্রতিনিয়ত পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানকে দূষিত করে। প্রকৃতির মাটি, পানি, বায়ু দূষণ হচ্ছে ভয়াবহ রকমের। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের সামগ্রী, চিপস্, চকোলেট, পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি এখানে সেখানে ফেলি। এতে মাটি দূষণ হচ্ছে মারাত্মক ভাবে। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য অবগতকরণ সভা, শিল্পকলা পরীক্ষায় ইকো ব্রিকস তৈরিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে নম্বরের জন্য হলেও শিক্ষার্থীরা ইকো ব্রিকস তৈরি করে আনবেন।পরিবেশ বান্ধব ইকো ব্রিকস তৈরি শেষে সেগুলো নিয়ে বাগান, বেঞ্চ, ডাস্টবিন তৈরি করা যায়। যার ফলে পরিবেশ প্লাস্টিক মুক্ত হবে। আমরা আগামী দিনের শিশুদের জন্য সুন্দর বাংলাদেশ রেখে যেতে পারবো।
এসব ছাড়াও ওই কর্মকর্তার উদ্ভাবন আমার স্বপ্ন, বই রাজা বই রাণী,ব্লক লিডার ও ব্লক মাদার’ ইত্যাদি উদ্ভাবনী কনসেপ্ট শিশুদের মেধাবিকাশ ও ব্যক্তিত্ব উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে বলে মতামত দিচ্ছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ।
সম্প্রতি তার বহুমুখী ও সৃজনশীল কর্মকান্ডে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক-২০২৪ হবিগব্জ জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন।