সিরাজদিখানে যুগযুগ ধরে চলছে হাড়জোড়া চিকিৎসা দেয়ার নামে অপচিকিৎসা

274851798_621570722473571_7457564273598866248_n.jpg

লিটন মাহমুদ, মুন্সীগঞ্জ থেকে : সিরাজদিখানে যুগযুগ ধরে চলছে হাড়জোড়া চিকিৎসা দেয়ার নামে অপচিকিৎসা। হাড় ভাঙা আর গাছ ভাঙা জোড়া লাগা একই রকম। গাছ ভেঙে পড়ে। মানুষ ভেঙেও পড়ে আবার পড়েও ভাঙে। মটকা গাছ সহজে ভেঙে পড়ে। রোগাক্রান্ত হাড় ও ক্ষয়প্রাপ্ত হাড়ও সহজে ভেঙে যায়। বৃদ্ধ মানুষের পায়ের উপরের অংশ একটু সরু থাকে যাকে নেক অব ফিমার বলা হয়। এখানেই সাধারণত বৃদ্ধদের ভেঙে যায়। ভালো মানুষ খাড়া অবস্থায় বা হাটা অবস্থায় অথবা একটু চোট খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সবাই বলে আছাড় পড়ে ভেঙে গেছে। আসলে বলতে হবে ভেঙে পড়ে গেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পড়েই ভাঙে। কোন কোন সময় আঘাত লেগে হাড় ভেঙে খন্ড হয়ে যায়, বা ফেটে যায়। কোন কোন সময় একটু সরে যায় বা চোট লাগে। তখন বলে মস্কে গেছে। ভাঙুক আর মস্কুক প্রধান চিকিৎসা হলো হাড়টা যথাস্থানে বসিয়ে যে কোন পদ্ধতিতে নড়াচড়া বন্ধ রাখা। গাছ ভেঙে গেলে আমরা যদি জায়গামত বসিয়ে বেঁধে দেই দেখা যাবে গাছ জোড়া লেগে গেছে। তদ্রুপ হাড় ভেঙে গেলে সোজা করে ঠিক জায়গায় বসিয়ে প্লাস্টার কাস্ট দিয়ে নির্দিষ্টকাল রেখে দিলে । তাতে জোড়া লেগে যায়। কোন ওষুধ লাগে না। তবে ভিটামিন ও প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে তাড়াতাড়ি জোড়া লাগে। কোন কোন সময় মেটালের পাত স্ক্রু দিয়ে ভাঙা হাড়ের সাথে লাগিয়ে দেয়া হয় দ্রুত জোড়া লাগানোর জন্য।

অর্থোপেডিএক্স বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ হাড় ভাঙার চিকিৎসা করে থাকেন। আঘাত লেগে চামড়া ছিঁড়ে গেলে ভাঙা হাড়ে ইনফেকশন বা জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। তখন এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়।

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের চোরমদন ও দানিয়াপাড়া গ্রাম এই দুইটি গ্রামে যুগের পর যুগ ধরে চলছে সনাতনী পদ্ধতিতে হাড়জোড়া চিকিৎসা । সিরাজদিখান নিমতলা সড়কের চোরমদন শ্মশান ঘাট থেকে একটু সামনে এগুলে ডানে-বাঁয়ে দুই পাশেই চোখে পড়েবে অনুমতিহীন ৫-৬টি বিখ্যাত হাড়ভাঙ্গা চিকিৎসালয় । বাশের চোটি দিয়ে সনাতনী পদ্ধতিতে হাত-পা ভাঙ্গা জোড়া দিচ্ছে হাতুড়ে চিকিৎসাক।

জানায়ায় দীর্ঘ দিন ধরে নিয়মিতভাবে হাত-পা ভাঙ্গা জোড়া দেওয়ার চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। প্রথম কয়েক দিন ভাঙা হাত-পায়ে গাছের ছাল-বাকল-লতাপাতা লাগিয়ে রাখা হয়। তারপর টানা ৬দিন হাত ও পায়ের দুই পাশে ইট দিয়ে চেপে রাখা হয়। পরে প্রতিদিন চলতে থাকে ঝাড়ফুঁক-মালিশ। এভাবেই চলে চিকিৎসা। কেরানীগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা ইমন হোসেন জানান, আমার পায়ের হাড় ভেঙে গেছে বেশ কিছুদিন আগে। লোকমুখে শুনে এইখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি। কবিরাজ বাশের চোটি দিয়ে বেধে দিয়েছে আর ব্যাথা-বেদনা কমানোর জন্য রোলাক নামের ট্যাবলেট দিয়েছে। প্রায়ই এক মাস হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখন সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি।

আরেকজন চিকিৎসা নিতে আসা আওলাদ হোসেন বলেন, আমি সোসেল কবিরাজের থেকে আমার হাত ভাঙ্গার চিকিৎসা করেছি। সে দীর্ঘদিন আমার থেকে তেল মালিশ দিয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার এখন পর্যন্ত হাত ভালো হয়নি। এরকম হাতুড়ে কবিরাজদের পিটিয়ে এলাকা থেকে উঠিয়ে দেওয়া দরকার। তা না হলে মানুষের আরো অনেক ক্ষতি হবে আমার মতো। আমি এখন ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি, মোটামুটি আগের থেকে একটু ভালো হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে আর কখনো আমিও যাবো না এরকম হাতুড়ে কবিরাজের কাছে।

বিখ্যাত হাড় ভাঙ্গা চিকিৎসালয়ের হাতুড়ে কবিরাজ রতন জানান, ১৭-১৮ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত আছি। অনেকে আমার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছে। হাড়া ভাঙ্গা চিকিৎসালয়ের বৈধতা আছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, শ্রীধাম চন্দ পালের কাছ থেকে চিকিৎসা দেয়া শিখেছি, ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স আছে, তবে সরকারি কোনো অনুমোদন নেই। তিনি আরো জানান, ধানিয়াপাড়া গ্রামের মাধপ চন্দ্র পাল, চোর মদন গ্রামের ইসমাইল সহ অনেকে বছরের পর বছর ধরে এই পেশায় জড়িত আছে।

হাড় ভাঙ্গা হাতুড়ে কবিরাজ হাওলাদার সোসেল বলেন,আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও জানি কী কী করতে হয়। আমি গর্ভবতী নারী এবং রোগীর ডায়াবেটিস থাকলে চিকিৎসা করি না। তাই কাজের(চিকিৎসা) ক্ষেত্রে কোনো সমস্যাও হয় না। প্রথম কয়েক দিন ভাঙা হাত-পায়ে গাছের ছাল-বাকল-লতাপাতা লাগিয়ে রাখা হয় এবং ব্যথানাশক ঔষুধ লিখে দেওয়া হয় ব্যথা হলে খেতে রোগীকে। পরে প্রতিদিন চলতে থাকে ঝাড়ফুঁক-মালিশ।

অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ও সার্জন,ডা. মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম বলেন,অর্থোপেডিএক্স বিশেষজ্ঞ হাড় ভাঙ্গার চিকিৎসা করে থাকে। এটা তাদের কাজ,কবিরাজের কাজ না। যথাস্থানে ভাঙ্গা হাড় না বসিয়ে প্লাস্টার করলে হাত বা পা পরবর্তীতে বাঁকা হয়ে যেতে পাড়ে। ছাল-বাকল-লতাপাতা থেকে ইনফেকশন হয়ে পচন ধরতে পাড়ে। তাই অর্থোপেডিএক্স বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে হাড় ভাঙ্গার চিকিৎসা করতে হবে।

এবিষয়ে রশুনিয়া ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবু সাইদ বলেন, এ বিষয়ে আমি জানতাম না, যেহেতু আমি এবার নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে এসেছি, তবে আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো, এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আঞ্জুমান আরা জানান, এদের সরকারি ভাবে কোনো অনুমোদন নেই সুতরাং এই কবিরাজি পদ্ধতি চিকিৎসা তারা দিতে পারেন না। এর আগে একবার মোবাইল কোটের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এখন আবার তারা পুনরায় হাড় ভাঙ্গা চিকিৎসা দিচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলে প্রশাসনিক ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

মুন্সীগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল আলম জানান, বিষয়টি আমি আগে জানতাম না আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম, আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখব যদি সরকারি অনুমতিহীন এর রকম ভাড় ভাঙ্গা চিকিৎসালয় থেকে হাড় ভাঙার চিকিৎসা করে থাকেন,তা হলে তাদের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবো।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top